শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় হতাহতের বড় অংশই এসেছে ঢাকা মেডিকেলে। এখান থেকে প্রায় একশ’ মানুষের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে গেছেন। আঞ্জুমানের মাধ্যমে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এখনো হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে ১৯ জনের লাশ। তাদের বয়স আনুমানিক ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। অজ্ঞাত হিসাবেই তাদেরকে মর্গে রাখা হয়েছে। কারণ তাদের পরিচয়ও মিলছে না বা স্বজন পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে মর্গে আসেন। কিন্তু মর্গে রাখা মরদেহগুলোর শারীরিক অবস্থা দেখে শনাক্ত করা বা চেনার কোনো উপায় নাই।
ঢামেকের তথ্যমতে, সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৯৮ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রড ডেড ছিল ৪৭ জন।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এ সময় গুলিতে মারা গেছেন শত শত সাধারণ শিক্ষার্থী ও পুলিশ ও সাধারণ মানুষ। কয়েকটি মরদেহ এসেছে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে। মরদেহগুলো বিকৃত হওয়ায় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের স্বজনদের। লাশগুলো পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে আসলেও মর্গে রাখা মরদেহগুলো দেখে চিনতে পারছেন না কেউ। থানার কার্যক্রম পুরোদমে চালু না হওয়ায় করা যাচ্ছে না সুরতহাল। মরদেহগুলো নিয়ে বিপাকে রয়েছেন ঢামেক কর্তৃপক্ষও। এদিকে ঢামেকের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সহিংসতার ঘটনায় আহতরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে এসেছেন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হাসপাতাল থেকে। কারও মাথায় গুলি, কারও পেটে, কারও হাতে-পায়ে। অনেকে রয়েছেন আইসিইউতে ভর্তি। ব্যস্ত সময় পার করছেন চিকিৎসক-নার্স। সরকার পতনের পর হাসপাতালে গুরুতর আহত অনেককে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়। আবার কয়েকটি মরদেহ মৃত্যুর দুই-তিনদিন পরও রাস্তায় পড়ে থাকে। তাদের মধ্যে পুড়ে যাওয়া মরদেহও রয়েছে। মর্গে থাকা সংশ্লিষ্টরা জানান, মরদেহগুলো এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে দেখে চেনার উপায় নেই।
মর্গের সামনে ছবি হাতে ভাইকে খুঁজছিলেন সেলিম। তিনি বলেন, আমার ভাই আবু রায়হানকে ২৪ তারিখের পরে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঢাকায় এসেছিল। মাস্টার্স পাস করেছে। সে গাবতলীতে একটি গার্মেন্টেসে চাকরি নিয়েছিল। আমরা ধারণা করতেছি এই গোলাগুলিতে তার কিছু হতে পারে।
স্বামীর ছবি হাতে মর্গে মর্গে ঘুরছেন স্ত্রী ফাতেমাতুজ্জোহরা। বলেন, আমার স্বামী নুরন্নবী আনসার ব্যাটেলিয়ানে চাকরি করে। সে যাত্রাবাড়ীতে ডিউটিতে ছিল। ৫ তারিখ বিকালে মারাত্মক আকারে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তখন আমার সঙ্গে তার কথা হয়। গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছি মোবাইলে। এ সময় সে বলে, ‘মারাত্মক সংঘর্ষ হচ্ছে, আমাকে তুমি মাফ করে দিও, এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।’ কিছুক্ষণ পরে মোবাইলে বলে, তার বুকে একটা গুলি লেগেছে। এরপরে আর মোবাইল খোলা পাইনি। এখন সবজায়গায় খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না। ঢামেকের মর্গে মরদেহের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হচ্ছে আমার স্বামীর মতো তবে সেটি পুরোপুরি না মিললেও ৭০ শতাংশ নিশ্চিত হতে পেরেছি।
মর্গে দায়িত্বরত শাহবাগ থানার কনস্টেবল সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান বলেন, যাদের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে সেগুলো তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকি ১৯টি লাশের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। শুরু থেকেই সিআইডিকে আমরা বলেছিলাম তারা জানিয়েছিলেন, ‘তাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।’ মরদেহগুলো দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। মরদেহের ছবি তুলে রাখা হয়েছে। যে মরদেহগুলো শনাক্ত না হলে প্রক্রিয়া শেষে আঞ্জুমান মুফিদুলে হস্তান্তর করা হবে। থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সমস্যা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কলেজের মর্গে ৮টি মরদেহ রয়েছে। তিন-পাঁচদিন মরদেহ রাখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় রাখতে হয়। কিন্তু থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রক্রিয়ায় যেতে পারছি না। তবে দুই-একদিনের মধ্যে হয়তো প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। আমরা থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরুর অপেক্ষায় আছি। যদি পুলিশ সুরতহাল করে দেয় তাহলে আমরা অটোপসি করে দিবো। ডিএনএ স্যাম্পল রেখে সেগুলো আনঞ্জুমান মুফিদুলে দিয়ে দিবো। পরে যদি কেউ দাবি করেন তখন ডিএনএ টেস্ট করা হবে। আমাদের মরচুয়ারি ঘরে আনার পরে মরদেহের খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে বাইরে বেশিক্ষণ থাকা অবস্থায় মরদেহগুলোর পচন ধরে। বড় বড় ঘটনাগুলোতে ঢামেকে চাপ পড়ে। আমরাও সেইভাবে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। আমাদের মরচুয়ারি যদি আরও একটু উন্নত ও স্পেস বাড়ানো হয় সেটি আমাদের জন্য ভালো হয়। ৪০টি মরদেহ রাখার সক্ষমতা রয়েছে। সহিংসতার এই ঘটনায় এমনো হয়েছে একদিনে ৩৯ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে।
ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, সংষর্ষে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫০ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসাধীন রয়েছে ১৯৪ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৪ জন। প্রথম থেকে এই পর্যন্ত ৯৮ জনের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এই ৯৮ জনের মধ্যে ৪৭ জন ছিল ব্রড ডেড। আর ময়নাতদন্ত ছাড়া কিছু মরদেহ নিয়ে গিয়েছে এর সংখ্যাটা আমরা বলতে পারছি না। তখন যে পরিস্থিতি ছিল মর্গ খুলে জোর করে অনেকের ডেড বডি নিয়ে গিয়েছে। আমরা বলেও তাদেরকে বোঝাতে পারিনি। মর্গে এখনো কিছু মরদেহ রয়েছে। রোগীরা অনেকে ফলোআপ করতে আসছেন। আবার ঢাকা ও বাইরের হাসপাতাল থেকে রোগীদের রেফার করা হচ্ছে। যারা এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ১০ জন আইসিইউতে ভর্তি আছে। অনেকের নারী ছিঁড়ে গিয়েছে বা ক্রিটিক্যাল অনেক রোগী আছে তাদের আসলে কি অবস্থা হবে এখনো বলা যাচ্ছে না।